ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার অভিযোগে বাউল রিতা দেওয়ানসহ তিনজনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে বাংলাদেশ সাইবার ক্রাইম ট্রাইব্যুনাল। পালা গানের মাধ্যমে বাউল রিতা দেওয়ান আল্লাহকে নিয়ে ‘অশালীন উক্তি’ করে ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত’ দিয়েছেন এমন অভিযোগে এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে তার বিরুদ্ধে দুটি মামলা দায়ের হয়েছিল, যার মধ্যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের মামলায় বুধবার এই পরোয়ানা জারি হয়েছে।
সাইবার ক্রাইম ট্রাইব্যুনালের পাবলিক প্রসিকিউটর নজরুল ইসলাম শামীম বিবিসিকে বলেছেন, ফেব্রুয়ারি মাসে দায়ের মামলার তদন্ত শেষে আদালত এই পরোয়ানা জারি করেছে। রিতা দেওয়ান সংবাদ মাধ্যমকে বলেছেন, আইনের প্রতি সম্মান দেখিয়ে তিনি আদালতে আত্মসমর্পণ করবেন। তিনি নিজেকে নির্দোষ দাবি করে বলেছেন, ফেব্রুয়ারি মাসেই তিনি ওই ঘটনার জন্য ইউটিউবে ক্ষমা চেয়েছেন।
মানিকগঞ্জের এই বাউল শিল্পী রিতা দেওয়ান বলছেন, এই বিতর্কের যখন শুরু অর্থাৎ জানুয়ারি মাসের শেষ থেকে এখন পর্যন্ত তাকে নানাভাবে হেনস্তা করা হয়েছে। তিনি বলেন যে ভিডিও নিয়ে এই বিতর্কের সূত্রপাত, সেই পালা গানের আসরে প্রতিপক্ষের আক্রমণের জবাব দিতে গিয়ে তার ভুল হয়েছে। রিতা দেওয়ান বলেছেন, “এজন্য আমি ক্ষমা চেয়েছি, ওই কথাটা আমার ভুল হয়েছে।”
“আমি তো মুসলমান, আমি তো আল্লাহকে খারাপভাবে কিছু বলতে পারি না। ওটা গানের মঞ্চে প্রতিপক্ষ ছিলেন শাহআলম সরদার, তার আক্রমণের জবাব দিতে গিয়েই ভুলটা হয়েছে।” তবে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইলেও, ওই বিতর্কের কারণে রিতা দেওয়ান ও তার পরিবারকে হয়রানির মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে।
তিনি বলেন, “বিশেষ করে সামাজিক মাধ্যমে নানা ধরণের গালিগালাজ করে, হুমকি দিয়ে ভিডিও বানানো হয়েছে। স্থানীয়ভাবেও আমাকে এসবের মুখোমুখি পড়তে হয়েছে।” এ কারণে রিতা দেওয়ান ও তার পরিবার ভয়ে ভয়ে দিন কাটাচ্ছেন বলে উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, “ফেব্রুয়ারি মাস থেকে এখন পর্যন্ত একদিনও মঞ্চে গান করিনি। যেসব জায়গায় এই পালা গানের আয়োজন করা হয়, আমার এই বিতর্কের কারণে আয়োজকেরা অনুমতি পায় না অনুষ্ঠান করার। এজন্য এখন আর তারা আমাকে অনুষ্ঠানে নিতে চান না।”
এ কারণে নিরাপত্তার অভাবের পাশাপাশি রিতা দেওয়ানকে জীবন-জীবিকা নিয়েও প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে। গত মাসখানেক ধরে শারীরিকভাবেও অসুস্থ হয়ে রয়েছেন বলে বিবিসিকে জানিয়েছেন তিনি। মামলার তদন্ত করার দায়িত্ব ছিল পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন পিবিআই’র ওপর, সংস্থাটি গত ২৯শে অক্টোবর আদালতে তদন্ত রিপোর্ট জমা দিয়েছে।
পাবলিক প্রসিকিউটর নজরুল ইসলাম শামীম বলেছেন, “রিতা দেওয়ানের বিরুদ্ধে মামলায় যে অভিযোগ আনা হয়েছে, তদন্তে তার প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া গেছে বলে রিপোর্ট দেয়া হয়েছে। “সে কারণে এখন বাউল রিতা দেওয়ানসহ মোট তিনজনের নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে।”
মামলায় শুধুমাত্র রিতা দেওয়ানকে আসামি করা হয়েছিল, কিন্তু মামলার তদন্ত শেষে ভিডিও দৃশ্য ধারণ এবং ইউটিউবে আপলোড করার অভিযোগে আরো দুইজনকে আসামি করা হয়েছে।শাজাহান এবং ইকবাল নামের এই দুইজনের নামের কেবল প্রথম অংশটি জানিয়েছেন পাবলিক প্রসিকিউটর মি. ইসলাম। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আইনজীবী মোহাম্মদ ইমরুল হাসান গত ২রা ফেব্রুয়ারি মামলা দায়ের করেন।
বিবিসিকে মোহাম্মদ ইমরুল হাসান বলেন, “মামলার আর্জিতে বলা হয়েছে, একটি পালা গানের আসরে প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করতে গিয়ে রিতা দেওয়ান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহকে নিয়ে ‘ধৃষ্টতা ও কুরু চিপূর্ণ’ মন্তব্য করেছেন, যা মানুষের ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত’ হেনেছে। এবং এটা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ধারা অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ। সেজন্য তার প্রতিকার চেয়ে ওই মামলা দায়ের করা হয়।”ইউটিউবে রিতা দেওয়ানের সেই পালা গানের ভিডিও ভাইরাল হবার পর, পয়লা ফেব্রুয়ারি তিনি ইউটিউব ভিডিও’র মাধ্যমে ক্ষমা চান।
পাবলিক প্রসিকিউটর মি. ইসলাম জানান, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৮ এর ১ নম্বর ধারা অনুযায়ী ধর্মীয় মূল্যবোধ বা অনুভূতিতে আঘাত করা বা উস্কানি দেয়ার অপরাধ প্রমাণিত হলে কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে অনধিক পাঁচ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন।
এ বছরের জানুয়ারি মাসেই আরেকজন বাউল শিল্পী শরিয়ত সরকারকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নেয়া হয়েছিল। বিষয়টি নিয়ে সেসময় লোকসংগীত শিল্পী এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীদের মধ্যে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। (বিবিসি বাংলা)