চাঁপাইনবাবগঞ্জে রাকিব-রেহেনা দম্পতির প্রতারণায় অতিষ্ঠ এলাকাবাসী, প্রতিবেদককে হুমকী

0
221

 

চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রতিনিধি ॥ চাঁপাইনবাবগঞ্জের ঝিলিম ইউনিয়নের আতাহার চাঁদলাই এলাকায় বিতর্কিত সাহেদ-সাবরিনার অনুসারী রাকিব-রেহেনা দম্পতির খোঁজ মিলেছে। রাকিব-রেহেনা দম্পতির বিরুদ্ধে প্রতারণা-অত্যাচারসহ নানা অভিযোগ।

সাংবাদিকদের অনুসন্ধানে ও এলাকাবাসীর অভিযোগে বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য। আর এই রাকিব-রেহেনা দম্পতি এ নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করা হলে ‘সাংবাদিকের পায়ের নিচের মাটি থাকবে না’ বলে হুশিয়ারিও দিয়েছেন। অতিষ্ট এলাকাবাসী ও ভূক্তভোগীরা রাকিব-রেহেনা দম্পতির দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবী জানিয়েছেন।

রাকিব-রেহেনা দম্পতি নিজেদের পরিচয় দেন, কখনো সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের আত্মীয়, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা আওয়ামীলীগের বড় বড় নেতাদের নাতনী, জেলা মহিলালীগের সভাপতি, একজন আইনজীবী ও চিকিৎসক হিসেবে।

আর এসব রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করে দেহ ব্যবসা, সরকারি চাকুরি ও বিভিন্ন সুবিধা দেয়ার নাম করে বিপুল পরিমান অর্থ আদায়, চেক জালিয়াতি, অন্যের আইডি কার্ড ব্যবহার করে ঝণ নেয়া, মসজিদের অর্থ আত্মসাৎ, সরকারি পুকুরের মাছ মেরে নেয়াসহ বিভিন্ন অনিয়ম, দূর্নীতি, প্রতারণা ও জালিয়াতি করে এলাকায় সাহেদ সাবরিনা খ্যাত দম্পতি সেজেছেন রাকিব-রেহেনা দম্পতি।

অনুসন্ধানে এসব অনিয়মের কথা উঠে আসে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার ঝিলিম ইউনিয়নের আতাহার-চাঁদলাই গ্রামের মো. গোলাম রাব্বানীর ছেলে রাকিব আলী ও
তার তৃতীয় স্ত্রী মোসা. রেহেনা খাতুনের বিরুদ্ধে। অভিযোগ রয়েছে, তাদের এসব কর্মকান্ডের বিরোধিতা করলেই মামলা-হামলা ও ক্রসফায়ারের হুশিয়ারী দেয় রাকিব-রেহেনা দম্পতি।

এছাড়া জঙ্গি ও মাদক ব্যবসায়ী হিসেবে পুলিশে দেয়ার হুমকি দেখিয়ে দমিয়ে রেখেছে চাঁদলাই গ্রামের শতাধিক পরিবারকে। দলীয় কোন পদে না থাকলেও সরকারি দলের
নাম ভাঙ্গিয়ে বিভিন্ন অনিয়ম করেই চলেছে এই দম্পতি। ফেসবুকে ব্যক্তিগত আইডিতে রাকিবের টাইমলাইনেও দেখা গেছে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামীলীগের প্রশংসা নিয়ে বিভিন্ন পোস্ট শেয়ার করতে। আর এসব ব্যবহার করেই ফায়দা নেয়ার অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধে। এমনকি

সংবাদটি প্রকাশ হলে প্রতিবেদককেও দেখে নেয়ার হুমকি দেয় রেহেনা খাতুন নিজেই।
জানা গেছে, নিজেকে চিকিৎসক ও আইনজীবী হিসেবে পরিচয় দেয়া রাকিব-রেহেনা দম্পতি ৬-৭ বছর আগে শিবগঞ্জ থেকে চাঁদলাই গ্রামে এসে বসবাস শুরু করেন। তবে শিবগঞ্জ থেকে চলে আসার কারন হচ্ছে, সেখানে সেনাবাহিনী, পুলিশ, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক, নার্সের চাকুরি দেয়ার নাম করে প্রায় কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়
এই দম্পতি।

পরে ভুক্তভোগীদের মামলায় ৪ বছর আগে ৪০ দিন জেল খেটে জামিনে বের হয়ে আসেন রাকিব আলী। অভিযোগ রয়েছে, দীর্ঘদিন ধরে জেলা শহরের বিশ্বরোড মোড়স্থ আবাসিক হোটেল হাফেজিয়া বোডিংয়ে মেয়ে সরবরাহের কাজ করে থাকে রাকিব। এনিয়ে, একবার পুলিশ তাকে আটক করে। যা বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশও হয়।

এলাকাবাসী জানায়, এখন তার বাসাতেই চলে দেহ ব্যবসা। মাঝে মধ্যেই রাতের বেলায় মাইক্রো বাসে করে খদ্দের ও অচেনা মহিলাদের যাতায়াত রাকিব-রেহেনা দম্পতির বাসায়। রাকিবের প্রথম স্ত্রী আমেনাকেও ব্যবহার করা হতো এই অনৈতিক কাজে। চাঁদলাই গ্রামের যুবক রজব আলী বলেন, ৮-১০টি পরিবারের কাছে
সরকারি বরাদ্দের পানির পাম্প দেয়ার কথা বলে ২৭ হাজার থেকে ৪০ হাজার
করে টাকা নিয়েছে।

গ্রামের ইউসুফ আলীর ছেলে জাহাঙ্গীরের কাছে ৩৮ হাজার, আফতাবের ছেলে মনিরুলের কাছে ২৭ হাজার, আজহারুলের কাছে ২৯ হাজার টাকা নেন রাকিব-রেহেনা। এছাড়াও গ্রামের সহবুল, ময়না বেগম ও শফিকুলসহ আরো কয়েকজনের থেকে বিভিন্ন পরিমানে অর্থ নেয়ার কথা বলেন রজব আলী।

স্থানীয় মো. রহমত আলী জানান, ১০ বছর আগে মৃত শরিফুলের স্ত্রী শুকতারার কাছে ব্যাংক হতে টাকা উঠিয়ে দেয়ার নামে চেক জালিয়াতি করে ৫০ হাজার টাকা নিয়ে ঢাকায় পালিয়ে যায় রাকিব। একই গ্রামের রেজাউলের স্ত্রী সুলতানার কাছে ত্রাণ দেয়ার নাম করে তার জাতীয় পরিচয়পত্র নেন রাকিব।

এই আইডি কার্ড ব্যবহার করে একটি এনজিও থেকে ২০ হাজার টাকা ঝণ নিলে ফেঁসে যায় দিনমজুর রেজাউল। এমনকি করোনাকালে সরকারি সহায়তা দেয়ার কথা বলে ৪০-৫০টি পরিবারের কাছে জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি নেন এবং ওইসব পরিবারকে নানা প্রতিশ্রুতি দিয়ে হয়রানী করেন রাকিব-রেহেনা দম্পতি।

দিনমজুর টুটুল আলী বলেন, বিভিন্ন মন্ত্রী-এমপি’র নাম ভাঙ্গিয়ে চলেছে স্বামী-স্ত্রী। এমনকি বিরাট বড় আওয়ামীলীগ নেতা-নেত্রী পরিচয় দেয় তারা। আর এসব শুনে ভয়ে তাদের বিরুদ্ধে কেউ প্রতিবাদ করতে পারেনা। রাকিবের আপন চাচা মো. মনি রুল ইসলাম জানান, গ্রামের চাঁদলাই জামে মসজিদের জমি দিয়েছিলেন আমার বাবা ও রাকিবের দাদা মৃত আলফাজ উদ্দীন।

তাই মসজিদের সকল কর্মকান্ডেও কর্তৃত্ব দেখাতে চাই রাকিব-রেহেনা। নিজে মসজিদ কমিটির কোন সদস্য না হলেও চাচাতো ভাই খোকন সভাপতি হওয়ায় মসজিদের কোটার টাকাও আত্মসাৎ করে তারা। ১ বছর আগে মসজিদের জন্য বরাদ্দ ২ টন চাল নিজেরাই ভোগ করেছে।

২ বছর আগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে কাজ করার কথা বলে মসজিদের হিসাব থেকে নগদ ৪০ হাজার টাকা নিয়ে ঢাকায় যায় রাকিব। তারপর এখন পর্যন্ত মসজিদের কাজের কোন খবর নেয়। তিনি আরো বলেন, ৩ বছর আগে তৎকালীন ইউপি চেয়ার ম্যান তসিকুল ইসলাম তসি মসজিদের সামনের ৩ বিঘার একটি সরকারি পুকুর মসজিদের নামে ইজারা নিয়ে দেন।

এই পুকুরেও জোরপূর্বক মাছ মেরে নেয় রাকিবের লোকজন। কেউ নিষেধ করলেই শুরু হয় তার উপর অত্যাচার। গত ১৫- ১৬ দিন আগেও রাতের অন্ধকারে মাছ মারার সময় আব্দুল মালেক নামের ব্যক্তি নিষেধ করতে গেলে তার উপর হামলা করে রাকিবের লোকজন। হামলায় গুরুতর আহত হয়ে ৪ দিন চাঁপাইনবাবগঞ্জ আধুনিক সদর হাসপাতালে ভর্তি ছিলো মামুন নামের একজন।

এলাকার মো. শরিফুল ইসলাম বাবু বলেন, মসজিদের ইমাম তাদের কথা মতো কাজ না করলেই তাকেও তাড়িয়ে দেয় রাকিব-রেহেনা। এমনকি ইমামদের জঙ্গি হিসেবে নাম দিয়ে পুলিশে ধরিয়ে দেয়ার ভয় দেখিয়ে নিজেদের আজ্ঞাবহ করে রাখে তারা।

অভিযোগ রয়েছে, সাহেদ-সাবরিনা খ্যাত রাকিব-রেহেনা দম্পতির কাজে তাদের সহযোগী হিসেবে বিভিন্ন হামলা ও অপকর্মে কাজ করে, রাকিবের চাচাতো ভাই খোকন, মামাতো ভাই আনারুল, ভাগ্নে আজিজুল, সবুজ, চাচা তরিকুলসহ আরো কয়েকজন।

এবিষয়ে ঝিলিম ইউনিয়ন পরিষদের ৭নং ওয়ার্ড সদস্য মো. মাইনুল ইসলাম বলেন, সরকারি পুকুর ও মসজিদ নিয়ে কয়েকবার সালিশ হলেও তা তারা কোন কিছুই মানে না। মেম্বার-চেয়ারম্যানকে কোন পাত্তা দেয় না। সালিশে বসলেই বড় বড় নেতাদের দোহায় দিয়ে দেমাকের সাথে কথা বলে স্বেচ্ছাচারীতা করে।

বর্তমান চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও ঝিলিম ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মো. তসিকুল ইসলাম তসি এব্যাপারে বলেন, ঝিলিম ইউনিয়নে চেয়ারম্যান থাকাকালীন সময়ে রাকিবকে বিআরডিবি’তে একটি কাজের ব্যবস্থা করে দেয়।

পরে সেখানে চাকুরিরত অবস্থায় সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করে ঢাকায় পালিয়ে যায় রাকিব। আবার নিজ এলাকায় ফিরে এসে লোকজনের কাছে বিভিন্ন সরকারি চাকুরি দেয়ার নাম করে বিপুল পরিমান টাকা নেয়।

তিনি আরো জানান, রেহেনায় হলো রাকিবের চালক। মসজিদের জন্য সরকারি পুকুর ইজারা করে দিয়েছিলাম, সেটিও দখল করে ভোগ করছে রাকিব ও তার লোকজন। তাদের এমন কর্মকান্ডে অতিষ্ঠ এলাকাবাসী।

তবে, সকল অভিযোগ অস্বীকার করেছেন রেহেনা খাতুন। একজন সমাজসেবক পরিচয় দিয়ে তিনি বলেন, আমাকে সামজিক ও রাজনৈতিকভাবে সম্মানহানি করতেই এমন অভিযোগ করা হয়েছে।

এসময় নিজেকে সদর উপজেলা মহিলালীগের পূর্বের কমিটির সদস্য হিসেবে পরিচয় দেন রেহেনা খাতুন। এমনকি সংবাদটি প্রকাশ করা হলে সাংবাদিকের পায়ের নিচের মাটি থাকবে না, বলেও হুশিয়ারি দেন রেহেনা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here