অপূর্ব কারুকার্যখচিত ইতিহাস-ঐতিহ্যের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে টাঙ্গাইলের নাগরপুর উপজেলার পাকুটিয়া জমিদার বাড়িটি। এখানে পাশাপাশি চমৎকার কারুকার্যখচিত তিনটি ভবন রয়েছে। নাগরপুর উপজেলার লৌহজং নদীর তীরে ১৫ একর জায়গাজুড়ে কালের সাক্ষী পাকুটিয়া জমিদার বাড়িটির প্রাকৃতিক ও মনোরম পরিবেশ সত্যিকার অর্থেই পর্যটকদের দৃষ্টি কাড়ে।
জমিদার বাড়িতে ঢুকতেই চোখে পড়ে পুরনো মন্দির। লোকমুখে শোনা যায়, এখানে শরৎ দিনে দেবী দুর্গার প্রতিমা তৈরিতে ব্যস্ত থাকতেন ভারতবর্ষের নামকরা প্রতিমা কারিগরেরা। কালের বিবর্তনে জায়গাটা এখন নির্জন, অনেকটাই বিধস্ত। নেই আগের সেই গৌরব আভিজাত্যের ছাপ, নেই প্রতিমা তৈরির কোনো চিহৃ। মন্দিরের সেই পুরনো ইটগুলো দিন দিন খসে খসে পড়ছে।
মন্দিরের পেছনে বিশাল তিনটি মহল যা সেকালে তিন তরফ নামে পরিচিত ছিল। মহলগুলোর আলাদা কোনো নাম পাওয়া যায়নি।
সবচেয়ে বড় মহলে বর্তমান পাকুটিয়া বিসিআরজি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ পরিচালিত হচ্ছে। কলেজটিতে বর্তমানে প্রায় হাজারের অধিক ছাত্র/ছাত্রী রয়েছে। শিক্ষক কমচারীর সংখ্যা প্রায় চল্লিশের অধিক। অযত্ন অবহেলায় কলেজটি পরিচালিত হচ্ছে।
সরজমিনে দেখা গেছে, কলেজের সুনিদিষ্ট কোন নোটিশ বোর্ড নাই। অধ্যক্ষের নেম প্লেটটি মুচ্ছে গেছে। অধ্যাপকে কক্ষে চলছে প্রভাষকদের সমাবেশ। তথ্য নিয়ে জানা গেছে, বর্তমান অধ্যক্ষ অধিকাংশ সময়ই ঢাকায় অবস্থান করেন।
দ্বিতল বিশিষ্ট ভবনের নির্মাণশৈলী মুগ্ধ করবে সবাইকে। তবে সংস্কারের অভাবে ভবনটিতে ফাটল দেখা দিয়েছে।তারপাশেই অপূর্ব লতাপাতার কারুকার্যখচিত বিশাল আরেকটি ভবন, যার মাথায় ময়ূরের মূর্তি রয়েছে, এ ছাড়া কিছু নারী মূর্তির দেখা মিলে। লতাপতায় আছন্ন ভবনটির একাংশ বর্তমানে উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্র এবং আরেক অংশে একটি বেসরকারি দাতব্য সেবা সংস্থা পরিচালিত হচ্ছে।
সর্বশেষে দ্বিতল বিশিষ্ট আরেকটি মহল যার সামনে বিশাল শান বাঁধানো সিঁড়ি। অন্যসব ভবনের সাথে এই ভবনের নকশার যথেষ্ট মিল খুঁজে পাওয়া যায়।
জমিদার বাড়ির পেছনে একটি দীঘি রয়েছে, আর আছে দুটি পরিত্যক্ত কূপ। একটি প্রাচীর ঘেরা ভাঙা বড় কূপের দেখা মিলে যেখানে সেকালের জমিদার গিন্নিরা স্নান করতেন। এ ছাড়া জমিদার বাড়ির বিশাল মাঠের এক কোণে নাট মন্দির রয়েছে। এক সময় নাচে-গানে মুখর থাকত এই নাট মন্দিরটি। বর্তমানে মন্দিরের কিছু অংশ জোড়ে ‘পাকুটিয়া ভূমি অফিস জায়গা করে নিচ্ছে।
পাকুটিয়া বাজারের পুরাতন ব্যবসায়ী প্রয়াত আব্দুল আজিজ ডিলার জানান, ইংরেজ আমলের শেষ দিকে এবং পাকিস্তান আমলের দীর্ঘ সময় পর্যন্ত তৎকালীন ব্রিটিশ রাজাধানী কলকাতার সাথে মেইল স্টিমারসহ মালামাল এবং যাত্রীবাহী স্টিমার সার্ভিস চালু ছিল কেদারপুর সংলগ্ন পাকুটিয়ার সাথে।
এই যোগাযুগের সূত্র ধরেই টাংগাইলের নাগরপুরের সাথে কলকাতার একটি বাণিজ্যিক এবং সাংস্কৃতিক সম্পর্ক গড়ে উঠে। আর তারই পরিপ্রেক্ষিতে পশ্চিমবঙ্গের বিষ্ণপুর থেকে প্রথমে রামকৃষ্ণ সাহা মণ্ডল নামে একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি পাকুটিয়াতে বসতি স্থাপন করেন।
ঊনবিংশ শতাব্দীর ঠিক শুরুতে ইংরেজদের কাছ থেকে ক্রয় সূত্রে রামকৃষ্ণ সাহা মণ্ডল জমিদারি শুরু করেন। রামকৃষ্ণ সাহা মণ্ডলের দুই ছেলে বৃন্দাবন ও রাধা গোবিন্দ। রাধা গোবিন্দ নিঃসন্তান কিন্তু বৃন্দাবন চন্দ্রের তিন ছেলে ব্রজেন্দ্র মোহন, উপেন্দ্র মোহন এবং যোগেন্দ্র মোহন। এভাবে পাকুটিয়া জমিদারি তিনটি তরফে বিভক্ত ছিল।
বৃন্দাবনের মেজ ছেলে উপেন্দ্রকে তার কাকা নিঃসন্তান রাধা গোবিন্দ দত্তক নেন। ফলে উপেন্দ্র মোহন দত্তক সন্তান হিসেবে কাকার জমিদারির পুরো সম্পদের অংশটুকু লাভ করেন। ১৯১৫ সালের ১৫ এপ্রিল প্রায় ১৫ একর এলাকাজুড়ে তিন ভাইয়ের নামে উদ্বোধন করা হয় একই নকশার পরপর তিনটি প্যালেস বা অট্টালিকা।
আজ অব্দি, দৃষ্টিনন্দন এ জমিদারবাড়িতে প্রতিদিনই ভিড় বাড়ছে পর্যটকদের। জমিদারিত্ব নেই, আছে শুধু জমিদারের ইতিহাসের সাক্ষী। জমিদার বাড়িটি সংস্কার বা জমিদারদের ইতিহাস সংরক্ষণ না হওয়াতে একদিকে যেমন সৌন্দর্য হারাচ্ছে পাকুটিয়া বাড়িটি, অন্য দিকে তরুণ প্রজন্মের কাছে অজানা থেকে যাচ্ছে এর ইতিহাস।
মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম, বাংলাটপনিউজ২৪.কম