ছয় বছর আগে মো. নূরে আলমকে পারিবারিকভাবে বিয়ে করেন ইফফাত বিনতে শরিফী মিশু (৩১)। এ দম্পতির কোলজুড়ে আসে দুটি সন্তান, মেয়ে হুমাইরা আলম (৩) ও ছেলে নিহাল নূর (২)। দুই সন্তান নিয়ে সংসার জীবন কিছুদিন ভালো চললেও হঠাৎ ইফফাত মিশুর সংসারে কালোছায়া নেমে আসে।
তিনি জানতে পারেন তার স্বামী আরেক নারীর সঙ্গে পরকীয়ায় মেতেছেন। শুধু তাই নয়, নূরে আলম আরও কয়েকজনের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়েছেন।
জানা যায়, নিহত ইফফাত মিশুর গর্ভে যখন আলমের দ্বিতীয় সন্তান নিহাল নূর তখন আলম দুই সন্তানের মা তালাকপ্রাপ্ত লুবানা আক্তার অনির সঙ্গে পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়েন। ইফফাত মিশুর দ্বিতীয় সন্তান জন্মের পর নূরে আলম মিশুর অনুমতি ছাড়া গোপনে অনিকে বিয়ে করেন।
বিয়ের তথ্য-গোপন এবং জালিয়াতির আশ্রয় নেয় নূরে আলম। নিহত ইফফাত মিশুর খালু ফিরোজ আলম বলেন, মিশু স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ের কথা জানলে দুই শিশু সন্তান নিয়ে চট্টগ্রামে বাবার বাসায় চলে যান। এরমধ্যে ইফফাত মিশু নূরে আলমকে তালাক দেওয়ার প্রস্তুতি নেয়।
পরে দুই সন্তানের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে তালাক না দিয়ে আলাদা থাকতে শুরু করেন। এরমধ্যে নূরে আলমের পরিবার মিশুর পরিবারকে জানান নূরে আলম অনিকে তালাক দিয়েছেন। তালাক কার্যকর হিসেবে খোলা তালাকের কপি মিশুর পরিবারকে দেখায়।
তারা জানায়, নূরে আলম তার ভুল বুঝতে পেরেছেন আর মিশুকে নিয়ে আবার সংসার করতে চান। নূরে আলমের পরিবারের অনুরোধে দুই পরিবারের মধ্যস্থতায় মিশু আলমের সংসারে ফিরে আসেন।
মেয়ের সংসার ও দুই নাতি-নাতনির কথা চিন্তা করে মিশুকে তার বাবা স্বামীর হাতে তুলে দেন। মিশু স্বামীর সঙ্গে রাজধানীর খিলগাঁওয়ের বাসায় ফিরে আসেন। নূরে আলমের সংসারে ফিরে আসার পর মিশু জানতে পারেন, নূরে আলম এবং অনির আনুষ্ঠানিকভাবে তালাক সম্পন্ন হলেও তারা আলাদা বাসা নিয়ে বিবাহ-বহির্ভূত অনৈতিক সম্পর্কে লিপ্ত আছেন। বিয়ের কাগজপত্র আর তাদের ঘনিষ্ঠ ছবিগুলো অনি নিজে মিশুকে দিয়েছিল।
তিনি বলেন, টিকটকে নূরে আলম ও তার প্রেমিকা অনির একাধিক অন্তরঙ্গ ছবি রয়েছে। মিশুর বাসায় অনির নিয়মিত যাতায়াত ছিল। অনিকে কেন্দ্র করে নূরে আলম আর মিশুর মধ্যে নিয়মিত ঝগড়া হতো আর নূরে আলম মিশুকে প্রায় সময় হত্যার হুমকি দিতো। ঢাকায় ফেরার পর এক মাস না যেতেই শুরু হয় মিশুর ওপর নির্যাতন।
এবার স্বামীর সঙ্গে শাশুড়িও নির্যাতন করায় যুক্ত হন। মিশুকে প্রায়ই যৌতুকের দাবিতে নির্যাতন করতেন তারা। এসব নিয়ে মিশুর সঙ্গে ঝগড়ার একপর্যায়ে গত ১৩ জুন দুপুরে মিশুকে পরিকল্পিতভাবে হত্যার পর মরদেহ সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখেন।
এ ঘটনায় পরদিন ইফফাত মিশুর বাবা মজিবুর রহমান, নূরে আলম, তার মা মাজেদা বেগম ও কথিত প্রেমিকা লুবানা আক্তার অনিকে আসামি করে ১৪ জুন খিলগাঁও থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলা নম্বর- ৪৪। মামলায় প্রধান আসামি নূরে আলম গ্রেফতার হলেও বাকি দুজনকে এখনো গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ।
আসামি লুবানা আক্তার অনির বাসা নারায়ণগঞ্জ বন্দর থানার মদনপুর বঙ্গশাসনে। তিনি থাকতেন রাজধানীর ডেমরা সারুলিয়ার টেংরা চেয়ারম্যান বাড়ি।নূরে আলম ও লুবানা অনির বিয়ের কাবিননামা ও তালাক নোটিশ সূত্রে জানা যায়, ২০২০ সালের ২৮ এপ্রিল বিয়ে হয় তাদের। এরপর ২০২১ সালের ১০ জুলাই তাদের তালাক হয়। তাদের বিয়ের দেনমোহর ছিল এক লাখ টাকা।
অন্যদিকে, ইফফাত মিশু নিহত হওয়ার পর তার মাকে খুঁজছে আদরের দুই সন্তান। যে সন্তানরা তার মাকে ছাড়া একবেলাও খেতে পারে না তারা তাদের মাকে খুঁজে বেরাচ্ছেন। অবুঝ দুই শিশুকে কোনো কিছুতেই সান্ত্বনা দিতে পারছেন না মিশুর বাবা-মা। মিশুর বাবার প্রশ্ন-মা হারা হুমাইরা ও নিহালের কী হবে?
মিশুর খালু ফিরোজ আলম বলেন, তিনজন আসামির মধ্যে পুলিশ একজনকেও গ্রেফতার করেছে। রিমান্ডের জন্য তাকে আদালত পাঠানো হয়। এসময় আসামি পক্ষ থেকে তার জামিন আবেদন করা হলে আদালত তা না মঞ্জুর দুইদিনের রিমান্ড দেন। বাকি দুই আসামিকে এখনো গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ।
মিশুর বাবা মজিবুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, দুই-তিন বছরের ছোট ছোট নাতি-নাতনি আমাদের কাছে রয়েছে। ওদের খাওয়া-দাওয়াসহ সব কাজ আমি আর ওদের নানি করছি। মাঝে মাঝে মায়ের জন্য কান্নাকাটি করে, তবে ওরা জানে ওদের মা হাসপাতালে রয়েছে। সুস্থ হলেই বাসায় ফিরবে।
মায়ের কথা জিজ্ঞেস করলেও বাবার কথা জিজ্ঞেস করে না। মিশুর বাবা বাকি দুই আসামির গ্রেফতার ও তার মেয়ের হত্যার সঠিক বিচার দাবি করেন।
মিশুর বাবা মামলায় উল্লেখ করেন— নূরে আলম তার মেয়েকে পছন্দ করতেন। তাদের পছন্দে ২০১৬ সালের জুলাই মাসে বিয়ে হয়। তাদের ৬ বছরে দাম্পত্য জীবনে হুমাইরা আলম এবং নিহাল নূর নামে সন্তান রয়েছে। বিয়ের পর থেকে শাশুড়ি মাজেদা বেগম মেয়ের কাছে যৌতুক দাবি করতেন।
মিশুর স্বামী বিভিন্ন মেয়ের সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্কে জড়ান। মামলার অভিযুক্ত তৃতীয় আসামি লুবনা আক্তার অনি দুই সন্তানের মা ছিলেন। তিনি স্বামীর সঙ্গে তালাকপ্রাপ্ত হয়ে নূরে আলমকে গোপনে বিয়ে করেন। বিয়ের কথা মিশু জানতে পেরে ২ সন্তান নিয়ে চট্টগ্রামে তার বাবার বাসায় চলে যান।
পরবর্তী সময়ে দুই পরিবারের সমঝোতায় নূরে আলম তার মেয়েকে ঢাকার বাসায় নিয়ে যান। কিন্তু ঢাকা নিয়ে মিশুকে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন শুরু করেন। একপর্যায়ে মিশুকে ১৩ জুন দুপুর ২টার দিকে মিশুকে হত্যার পর মরদেহ ঝুলিয়ে রাখেন।
নিজেই তার প্রতিবেশী বন্ধুর সহযোগিতায় মিশুকে বাসা থেকে প্রথমে মুগদায় ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে ও পরে কাকরাইলে ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখান থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে পাঠানো হয়। ঢামেক হাসপাতালে নেওয়ার পর কর্তব্যরত চিকিৎসকেরা বিকেল ৩টা ৫৫ মিনিটে মিশুকে মৃত ঘোষণা করেন।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা খিলগাঁও থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) সারোয়ার খান রাসেল বলেন, মামলাটির তদন্ত চলছে। এখন পর্যন্ত একজন গ্রেফতার হয়েছে। বাকি দুইজনকে গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। তবে মামলার তদন্তের স্বার্থে তাদের খুঁজে আইনের আওতায় আনা হবে।
মামলার অগ্রগতি ও আসামিদের সম্পর্কে জানতে চাইলে খিলগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফারুকুল আলম বলেন, মামলায় এখন পর্যন্ত একজনকেই গ্রেফতার করা হয়েছে। বাকিদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। আসামি নূরে আলমকে দুইদিনের রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। তার কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। সেগুলো যাচাই-বাছাই শেষে প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে। সূত্র: জাগোনিউজ24.কম