‘বৈশাখ’ বাঙ্গালী জাতির সার্বজনীন সাংস্কৃতিক উৎসব। সংস্কৃতি সম্পর্কে বলা যায়- কোন স্থানের মানুষের ভাষা, আচার-ব্যবহার, জীবিকা, সঙ্গীত, নৃত্য সাহিত্য, সামাজিক সম্পর্কীত শিক্ষা-দীক্ষা, রীতি-নীতির মাধ্যমে যে, অভিব্যক্তি প্রকাশ কর হয় তাই সংস্কৃতি। তাই সংস্কৃতিকে way of life বলা হয়। জাতী ও জাতীয়তার সাথে সংস্কৃতির সম্পর্ক নিরবিচ্ছিন্ন। একই সংস্কৃতির পরিমন্ডলে যেমন বিভ্ন্নি ধর্মের লোক থাকতে পারে, ঠিক তেমনী ঐক্যবদ্ধ জাতি গঠণে একটি অভিন্ন সংস্কৃতি গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা পালন করে। পুস্তকের ভাষায়, একই সংস্কৃতির সহজাত স্রোতধারায় বহু ধর্মের সংমিশ্রণে একটি অভিন্ন জাতীয়তা তৈরী হয় যা চিরাচরিৎ ধর্মীয় ধারনাকে বহুলাংশে মানবিক করে তুলে।
আর ধর্মীয় সংজ্ঞায় বলা হয়েছে- শয়তানের উপর জয়যুক্ত হওয়া এবং আত্মায় সত্যের আসন প্রতিষ্ঠা করাই ধর্ম। নিয়ম পালনের সাথে, জীবনের কদর্যতা সম্পর্কে সচেতন হওয়া প্রত্যেকটি মানুষের পবিত্র দায়িত্ব। সংস্কৃতিতে কদর্যতা থাকলেও বির্বতন যুগধারায় তা মানবিক পথে ধাবমান। তাই জ্ঞানীরা বলেন, ধর্ম হলো মৌলিক আর সংস্কৃতি তার দর্শন। তাই দর্শন বিহীন ধর্ম অসম্পুর্ণ।
বৈশাখের সাথে ধর্মের সংশ্রাব অর্থহীন। মুসলমানদের ধর্মগ্রন্থের কোথায় বৈশাখি উৎসব পালনের কথা উল্লেখ্য নাই। তবে বাঙ্গালী জাতির সংস্কৃতিতে বৈশাখী উৎসব পালন সার্বজনীন।
ইতিহাস ধারা থেকে জানা যায়, মুঘল সম্রাট আকবরের শাসনামলে বাংলা-উড়িষ্যায় এলাহী সন, মৌসুমী বা ফসলী সনের চালু ছিল। ঘরে ঘরে ফসল তুলার সাথে খাজনা আদায় ব্যাপক প্রচলন ছিল। এই জন্য সম্রাট আকবর জ্যোতিষ শাস্ত্রবিদ আমির ফতেউল্লাহ সিরাজীকে দিয়ে হিজরী সনের সাথে সামাঞ্জস্য রেখে তারিখ-ই-এলাহী সনের প্রচলন করেন যা পরবর্তীতে বৈশাখী উৎসব হিসাবে ভারতীয় উপমহাদেশে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে।
বৈশাখী উৎসব আজ বাংলা ভাষা-ভাষী বাঙ্গালীদের প্রাণের উৎসব। বৈশাখ শব্দটির উৎপত্তিতে সনাতন ধর্মের হৃদিত্ব রয়েছে। বাংলা ভাষার প্রাণকোষ বাংলা ব্যাকরণে বৈশাখ শব্দটির উল্লেখ্য পাওয়া যায় এই ভাবে-বৈশাখ+ষ্ণ, অস্তার্থে ।২।, মন্থণ দন্ড। বিশাখা+ষ্ণ। বি; পু। বিশাখা নক্ষত্রযুক্ত পুর্ণমা।
ইতিহাস বিদূত, বাংলাদেশের আদি জনগোষ্ঠিরা বহুকাল আগে থেকেই বৈশাখী উৎসব পালন করে আসছে। মূলতঃ আদি জনগোষ্ঠিরা বৈশাখী উৎসবকে বৈসাবি উৎসব হিসাবে পালন করত। বর্ণ বেদে তারা আলাদা আলাদা ভাবে, আলাদা আলাদা নামে এই উসৎব পালন করত। যেমন মারমা-রা, সাংগ্রাই, ত্রিপুরা-রা, বৈসু, তঞ্চঙ্গ্যা-রা, বিষ্ণু এবং চাকমারা বিজু উৎসব হিসাবে পালন করত। এই সকল উৎসবকে সম্মিলিত ভাবে বৈসাবি বলা হয় যা আজও তাদের সমাজে চেতনা ধর্মী উৎসব হিসাবে পালন করছে।
যুগ-যগান্তরের ইতিহাস স্বাক্ষ্য দেয়, বৈশাখ বা বৈসাবি উৎসব পালনের সাথে বৈদিক জাতি-গোষ্ঠির পুরান, বেদ বা সনাতন ধর্মের সংশ্রাব রয়েছে। হিন্দুরা বহুকাল আগ থেকেই বৈশাখি উৎসবকে তাদের ধর্মীয় উৎসব হিসাবে পালন করে আসছে।
উল্লেখ্য যে, পহেলা বৈশাখ যেমন বাঙ্গালীর হৃদয়ে নতুন উদ্বিপনা জাগিয়ে তুলে তেমন বর্গাচাষীদের জন্য এই দিনটি যন্ত্রণাদায়ক হিসাবে পরিচিত ছিল। সেই সময়ে এই দিনটিকে সম্পাদন করা হতো রাজস্ব আদায়ের দিন হিসাবে। প্রজারা বকেয়া খাজনা পরিশোধ করে জমিদার বাড়ীতে মিষ্টি মুখ করতো।
এখন সেই যুগের আবসান হয়েছে। পহেলা বৈশাখ এখন বাঙ্গালীর সার্বজনীন উৎসব হিসাবে পরিচিত পেয়েছে। এখন বৈশাখের লৌকিকতা পরিবার থেকে আরম্ভ। আত্মীয়-বন্ধু, ধর্ম-বর্ন নির্বিশেষে প্রতিবেশী সুহৃদজনকে শুভেচ্ছা ও কুশল জানানো, ছোট-বড়দের মধ্যে নবর্বষে আয়োজিত বৈশাখী মেলায় মিলন বন্ধন গড়ে উঠে। শিশু-কিশোরেরা চরকি, নাগরদোলা, বাঁশি আর তালপাতার রকমারি খেলনা নিয়ে মেতে উঠে। কিশোরীরা ব্যস্ত চূড়ি, ফিতা, চুলের ক্লিপ, আলতা, কাজল ইত্যাদি কেনার জন্যে।