১৯৯২ সাল, আমি তখন সরকারী ভিকু মেমোরিয়াল কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র। প্রফেসর সাইদুর রহমান স্যারের বাংলা (আওয়ামীলীগ নেতা) ক্লাস শেষ করে, বর্তমান কলেজের পুকুর সংলগ্ন টিনসেট ঘরের চিপায় প্রস্রাব করতে ছিলাম। তখন কলেজটির অবস্থা তেমন ভাল ছিল না। চিপা-চাপায় বসেই প্রস্রাবের কাজ সাড়া যেত। আমিও তাই করছিলাম। যদিও এটি ছিল সম্পূর্ণ অন্যায়।
সবেমাত্র কলেজে পা, তাই একটু আনাড়িও ছিলাম বটে। যা হোক, প্রকৃতির কাজ সারতে গিয়ে দেখি লকলকে তিন যুবক মুকুট বিড়ির প্যাক খুলে দেদারে ফুকঁছে। আমি উচ্ছুকতা বসতঃ কাছে যেতেই বিকট আওয়াজ তুলে ধমক খেয়ে –ভয়ে দৌঁড়িয়ে পাশ্ববর্তী আধাভাঙ্গা টিনের ঘরে আশ্রয় নিলাম। প্রায় ঘন্টা খানেক পালিয়ে থাকার পর বন্ধুর সহযোগিতায় বেড়িয়ে-ই, ভূ-দৌঁড়।
এই ঘটনার তিন দিনপর আবার সেই ছেলেদের দেখলাম-ওয়াসরুমে, অনেকটাই অপ্রকৃতিস্থ অবস্থায়। তারপর আমার এক বন্ধু কাছ থেকে জানলাম ওরা ‘নেতা’ এমনই। সম্ভবতঃ তিনের লম্বাজনের নাম মজিবর। জাতীয় পাটি করে। ওদের অনেক ক্ষমতা।
সেই সময় থেকেই আমি মজিবর নেতাকে চিনতাম। মনে মনে ভাবতাম বিড়ি খোড়রাই বুঝি নেতা হয়। পরে তথ্য নিয়ে জেনেছিলাম-দরগ্রাম ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মহুম এলাহী বক্স তাদের বিড়ির অর্থ যোগন দিতেন।
মজিবরের সাথে সুটাম দেহের মস্তান টাইপের আরও একটা ছেলে ছিল- যার নাম আতিকুর রহমান। সে প্রায়ই কলেজ গেটে পানির বোতল হাতে দাড়িঁয়ে থাকতো আর ছাত্র-ছাত্রী দেখলেই বোতল উঁচু করে দুইহাত নিচে মাথা রেখে গদগদ করে অভিনব কায়দায় পানি খেয়ে সবায়কে অবাক করে দিত। পরে দুইজনই দরগ্রাম ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের নেতা হয়েছেন।
আমি ১৯৯৪ সালে এইচএসসি পাশ করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। তারপর দীর্ঘ সাত বছর পরে আবার আমি মজিরব নেতাকে দেখি-এড্যাভোকেট মজিবর ভাই হিসাবে। অনুসন্ধানে জানি, এলাহী বক্স মরে যাবার পরে মজিবর দুই-দুইবার বিএনপিতে নাম লেখালেও শৃংখলা ভঙ্গের কারণে দলে স্থায়ী হতে পারে নাই।
জাতীয় পার্টির নেতা কর্ণেল মালেক সাহেব আওয়ামীলীগে যোগ দিলে পুনরায় মজিবরদের কদর বাড়ে। বিশেষ করে জাহিদ মালেক স্বপনের সময় তারা রাতারাতি নেতা বনে যান। একের পর এক বিতর্কীত কাজের নেতৃত্ব দিয়ে জাহিদ মালেক স্বপনের দৃষ্টি আকষর্ণে সক্ষম হন। মজিবর-দের অপর অ্যাডভোকেসি নেতা ছিলেন সাটুরিয়া উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান জনাব আব্দুল মজিদ ফটো।
মূলতঃ জাহিদ মালেক স্বপনের সাথে রাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় আব্দুল মজিদ ফটো এলাকার ছেলে হিসাবে মজিবরদের কাছে টানেন এবং বিভিন্ন প্রকার রাজনৈতিক সুবিধা দিয়ে নিজের বলয় বড় করার চেষ্টা করেন। কিন্তু হঠাৎ করেই জাহিদ মালেক স্বপন মন্ত্রী বনে গেলে মজিব-রেররা রাতারাতি রং বদলিয়ে ফেলে। পদ-পদবী দখলে মরিয়া হয়ে ফটো সাহেবের পক্ষ ত্যাগ করে মন্ত্রীরপক্ষ অবলম্বন করে।
জাহিদ মালেক স্বপন ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করতে বিতর্কীত মজিবরদের বড় বড় পদে আসিন করে সন্ত্রাসী রাজনীতি কায়েম উঠে-পড়ে লেগে যান। যার ফলে সমাজে তথাকথিত মজিবর নেতাদের উত্থান ঘটে।
উল্লেখ্য যে, এই সময় হতেই মজিবর মানিকগঞ্জ জেলাধীন সাটুরিয়া উপজেলার দরগ্রাম ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও মানিকগঞ্জ জজ কোর্টের আইনজীবীর পরিচিতি লাভ করেন। তার আইন পেশায় পরিচিতির অন্যতম হুতা অঘোষিত মানিকগঞ্জের বলরাম জনাব আব্দুল মজিদ ফটো ভাই। রাজনৈতিক ও আইন পেশাকে কাজে লাগিয়ে মজিবর, আশা-পাশের কয়েক ইউনিয়নের ‘বিচারক’ বনে যান-দুলে দুলা ভাবেই।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে লুটেরাগণ আত্মগোপনে চলে গেলে মজিবর-দের বিতর্কীত কর্ম জনতার চোখে ধরা পড়ে। ফলে তার বিরুদ্ধে একের পর এক অভিযোগ উঠতে থাকে ।
মঙ্গলবার (১১ ফেব্রুয়ারি) দুপুর ১২টায় মজিবর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ২ আদালতে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর মামলায় হাজিরা দিতে আসলে বিচারক রাহুল দেব শুনানি শেষে জামিন নামঞ্জুর করে মজিবর কে জেল হাজতে প্রেরণ করেন।
উল্লেখ্য তার বিরুদ্ধে ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে (১৩ আগস্ট মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া উপজেলার) বিজয় মিছিলের সময় দড়গ্রাম বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগ আনা হয়।
বিএনপির নেতা মো. শাহিন খান বাদি হয়ে আওয়ামী লীগ ও তার সহ-যোগী সংগঠনের ৩৮ জন নেতাকর্মীর নাম উল্লেখ্যসহ অজ্ঞাত ২০/২৫ জনকে আসামি করে সাটুরিয়া থানায় এই মামলাটি দায়ের করেন।
উক্ত মামলার এজাহারে ২ নম্বর আসামি অ্যাডভোকেট মজিবর রহমান হাইকোর্ট থেকে ৬ সপ্তাহের ডিরেকশন শেষে স্যারেন্ডার করে জামিন চাইতে আজ আদালতে হাজিরা দিতে আসলে বিচারিক আদালত জামিন নামঞ্জুর করে তাকে জেল হাজতে প্রেরণ করেন।
তথাকথিত অতিকথনের এই রাজনীতির খেলায় মজিবরেরা আসবে যাবে এটি সাময়িক দৃশ্যপট মাত্র। রাজনীতির ধারাপরিক্রমায় ওরাও একদিন হারিয়ে যাবে এটা যেমন সত্য; ঠিক তেমনী সত্য মজিবরদের রুখতে রাজনীতির চিরাচরিত এই ধারাপট পরির্বতন একান্তই জরুরী।