শুক্রবার, ৩১ জানুয়ারী ২০২৫, ১০:৫৮ অপরাহ্ন
বিজ্ঞপ্তি :
বাংলাটপনিউজ২৪.কম-এ দেশব্যাপী জেলা-উপজেলা পর্যায়ে সংবাদকর্মী নিয়োগ চলছে। সরাসরি যোগাযোগ করুন -banglatopnews24@gmail.com. মোবাইল-০১৭৪৩৯৯৮৭৪১.

সামন্ত যুগের বর্ণাঢ্য স্মৃতি; মানিকগঞ্জের বালিয়াটি জমিদার বাড়ীর রুপকথা !

লেখক: আসাদ জামান
  • আপডেটের সময়: মঙ্গলবার, ২৮ জানুয়ারি, ২০২৫
  • ৫৮ সময় দেখুন

সবুজ শ্যামল বাংলার আনাচে কানাচে কালের স্বাক্ষী হয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে অজস্র প্রত্নতত্ত্বনিদর্শন। যা দেখে সহজেই অনুমান করা   যায় কত ধন ও ধান্যের বিপুল সমৃদ্ধি ছিল এই বাংলা। অতীতের এই রজতকৃর্তিগুলো হতে পারে আমাদের ভবিষ্যৎ মহিমার দিগদর্শন। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে গড়ে উঠা জমিদারদের প্রাসাদোনুপম দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্য শৈলী, বহু ব্যয়ে নির্মিত এক একটি কালের স্বাক্ষী। মানিকগঞ্জের বালিয়াটি জমিদার বাড়িও সেই নিদর্শন গুলোর অন্যতম। কালের স্রোতে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া জমিদার শ্রেণীর সেই ভোগবিলাসের নিদর্শন যা ধ্বংসস্তুপের মাঝে সমহিমায় দাড়িয়ে আছে।

অশীতিপর বিগতযৌবনা নারীকে দেখে কেউ বুঝতে পারে না যৌবনে তার কত রূপ ছিল।  এ জমিদারবাড়ীর গল্পও তেমনি। পাচটি জমিদার বাড়ির গল্পে মোড়া বালিয়াটি জমিদার বাড়ি।

ধ্বংশ স্তুপের চিলেকোঠায় দাড়িয়ে এই চারটি বাড়ীই জানান দেয়া ইতিহাস প্রেমীদের-অনুসন্ধানের কৌতুহল। তার মধ্যে একটি বাড়ির একটি অংশ আজও অক্ষয় গৌরবে দাড়িয়ে একদা বীরন্যদের শৌর্য, সমৃদ্ধি ও ভোগ বিলাসের মহাকাব্যের স্বাক্ষী দেয়।

মানিকগঞ্জ জেলার সাটুরিয়া উপজেলার বালিয়াটিতে ভাগ্যের অন্বেষণে ঘিওর থানাধীন বিনোদপুর থেকে আসেন মহেশরাম সাহা। তিনি এখানেই এক পান ব্যবসায়ীর মেয়েকে বিয়ে করে থেকে যান। মহেশরামের ছেলে ঘনেশরাম পরবর্তীতে লবণের ব্যবসা করে বেশ উন্নতি করে।

পরবর্তীতে ঘনেশরামের চার ছেলের মধ্যে একজন টাঙ্গাইল জেলার আটিয়া ছাওয়ালী গ্রামে, একজন টাঙ্গাইলের নাগরপুরে, অপর জন মানিকগঞ্জের বিনোদপুরে চলে যায়। বাকি ছেলে গোবিন্দরাম বালিয়াটি তে বাবার সঙ্গে ব্যবসা চালিয়ে যায়। গোবিন্দরামের চার ছেলে আনন্দরাম, দধিরাম, পন্ডিতরাম ও গোপালরাম। এই চার ভাই থেকেই বালিয়াটিতে জমিদারিত্ব ও জমিদার বাড়ির সৃষ্টি হয় বলে ধারনা করা হয়। আনুমানিক আঠার শতকের প্রথম দিকে পাচটি জমিদার বাড়ি প্রতিষ্ঠিত হয়। গোলাবাড়ি, পূর্ববাড়ি, পশ্চিমবাড়ি, মধ্যবাড়ি ও উত্তর বাড়ী। এই পাঁচ বাড়ীর জমিদাররা পৃথক পৃথক তাদের পরগণা ও জমিদারি পরিচালনা করতেন। পাঁচ বাড়ির মধ্যে পশ্চিম বাড়ির কিছু ধ্বংসাবেশ এখনও লক্ষ্যনীয় যা নির্মান শৈলীতে কালের দর্শণ। তবে অনেক কিছু স্মৃতির অতলে হারিয়ে গেছে।

পূর্ব বাড়ীর জমিদার ও তার দর্শন নিরুপনেই মূলত: আজকের লেখা। পূর্ব বাড়ি জমিদারের পূর্ব পুরুষ দধিরাম। দধিরামের দুই ছেলে নিত্যানন্দ ও রায়চাঁন। দুই ভাই এজমালীতে লবণের ব্যবসা করতেন। পরে পৃথকভাবে সিরাজগঞ্জ,  নারায়ণগঞ্জ, ঝালকাঠি, নলছিটা, ললিতগঞ্জসহ বিভিন্ন জায়গায় লবণ, সুপারি, চাল ইত্যাদি দ্রব্যের ব্যবসায় বিপুল অর্থের মালিক হন। ক্রমে ক্রমেই তাদের ঐশ্বর্য বাড়তে থাকে এবং তারা জমিদারি ও তালুকদারি কিনতে আরম্ভ করে। এই দুই ভাই থেকেই পূর্ববাড়ি ও পশ্চিমবাড়ি জমিদারি শাসন শুরু হয়। তাদের বংশধরদের নানা কীর্তি ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছে।

রায়চাঁন দুই বিয়ে করেন। তিনি পূর্ব বাড়ির জমিদারির দশ আনা অংশ প্রথম স্ত্রীর সন্তান আর ছয় আনা দ্বিতীয় সন্তানদের দান করেন।

দশ আনীর জমিদার বাড়িটিই বর্তমানে দেশ বিদেশের পরিব্রাজকদের মন হরণ করে। তেরশত বঙ্গাব্দের পহেলা বৈশাখ এই বাড়ির জমিদারগণ গৃহে প্রবেশ করেন বলে জানা যায়। ছয় আনী জমিদার বাড়ির কোন অস্তিত্ব নেই। দশ আনী জমিদার বাড়ি পাঁচশত আটাশি শতাংশ ভূমির উপরে মূল সৌধমালা।

রাজচন্দ্র বড় তরফ, ঈশ্বরচন্দ্র মাঝার তরফ, ভগবান চন্দ্র নয়াতরফ, ভৈরবচন্দ্র ছোটতরফ এই চারজনের জন্য নির্মান করা হয় প্রাসাদোনুপম ভবন। লন্ডন ও কলিকাতা থেকে আনা নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার করে গড়ে তোলা হয় তিন তলা ও দ্বিতলা বিশিষ্ট অট্টালিকা। যা আজও অবিকৃত অবস্থায় দাড়িয়ে আছে।

বালিয়াটি জমিদার বাড়ি ঘিরে স্থানীয় ভাবে লোকমুখে নানা কথা চালু রয়েছে। যার বেশীর ভাগ শোষণ আর ত্রাসের। আজ হতে এক দেড়শত বছর আগে এ বাড়ির সামনে দিয়ে কেউ জুতা পায়ে বা ছাতা মাথায়, এবং কি ভাল জামা পরে চলাচল করতে পারতো না। আদেশ অমান্য করার সাধ্য ছিল না কারও, লাঠিয়ালদের খড়গ ছিল বড়ই সজাগ। তাছাড়া খাজনা আদায়ে ছিল বড়ই নির্মম। ব্রিটিশদের চোখে এটাই ছিল তাদের সাফল্য। আর এ কারণে বালিয়াটি জমিদারদের দেয়া হয় রায় বাহাদুর খেতাব। পূর্ববঙ্গে প্রতাপশালী হিন্দু জমিদারদের মধ্যে বালিয়াটি রায় বাহাদুররা বিত্ত প্রতিপত্তিতে শীর্ষস্থানীয় ছিল।

উনিশশত সাতচল্লিশ সনে ভারত ভাগের পর এরা প্রবল গণরোষের শিকার হন। জনতার আক্রোশে অট্টালিকায় চলে ভয়াবহ ভাংচুর ও লুটপাট। ফলে তারা স্বপরিবারে পালিয়ে যায়। পরিত্যক্ত সম্পত্তি হিসেবে সরকার পরবর্তীতে এই বাড়ীগুলো অধিগ্রহণ করে। ভূমি অধিদপ্তর থেকে দুইহাজার চার সালে জমিদার বাড়ির এসব ভবন পর্যটন কর্পোরেশনের কাছে বরাদ্দ দেওয়া হয়। পরে দুই হাজার সাত সালের দিকে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের কাছে হস্তান্তর করা হয়। তার পর থেকেই এই বাড়ীগুলো রক্ষনাবেক্ষন ও পর্যটনের জন্য তৈরী করা হয়। বর্তমানে প্রতিনিয়তই দূর দূরান্ত থেকে পর্যটকরা ভিড় জমাচ্ছেন দানবাকৃতি এ ভবন গুলো দর্শনের জন্য ।

উল্লেখ্য যে, অগাধ বিত্তের মালিক  এইঅভিজাত শ্রেণীর ভোগবিলাসী জীবন যাপনের কথা সর্বজনবিদিত। দেশের অন্যসব অঞ্চলের জমিদারদের মতই আভিজাত্য প্রমত্ত ছিল এরা। এলাকায় জনশ্রুতি আছে কন্যা সন্তান একটু বড় হলেই মায়েরা জমিদার বাবুর ভয়ে অন্য পরগণায় পাঠিয়ে দিত। বালিয়াটি জমিদারবাড়ির রংমহল নামের একটি কক্ষে অভিযাত শ্রেণীর নাচ গান হৈ হুল্লোড় চলত। রংমহলের সেই রঙ্গীন ভূবন বিবর্ণ হলেও রংমহলটি এখন পরিপাটি করে জাদুঘরে পরিণত হয়েছে। দেয়ালের সর্বত্র খাঁজ কাটা লতাপাতার নকশা। ছাদে লোহার চৌকাট কড়িকাঠে ছাঁচঢালা নকশা। সেখানে ঝুলছে বেশ কতগুলো ঝাড়বাতি। এগুলো আনা হয়েছিল লন্ডন থেকে। লুটপাট ও ভাঙচুরের পর জমিদার বাড়ির যে সব সামগ্রী অবশিষ্ট ছিল তা সংরক্ষণ করা হয়েছে রংমহলে।

অর্ধশতাধিক লোহার বড় সিন্দুক, ঐতিহ্যবাহী  কয়েকটি পালংক, নকশাখচিত কাঠের আলমারি, শ্বেতপাথরের নির্মিত টেবিল, টেবিলের উপর সাজানো স্ফটিকে তৈরী গাভী, বেশ কতগুলো ভগ্ন হেজাক হারিকেন, খানদানি চৌকি, নকশা সম্বলিত আরাম কেদারা, ভগ্নপ্রায় সিংহাসন, ছোট বড় অসংখ্য বাক্স সহ জমিদারদের ব্যবহৃত অসংখ্য নিদর্শন।

জমিদারবাড়িটি সাতটি বিশাল আকৃতির ভবন নিয়ে গঠিত চারিধারে উচু প্রাচীর দ্বারা ঘেরা। ভেতরে শান বাধানো সাত ঘাটলার পুকুর। কথিত আছে বিভিন্ন পূজা ও অর্চনা অনুষ্ঠানে সাত ঘাটের পানির প্রয়োজন হয়। এ বাড়ির প্রতিটি ইঞ্চিতে ছড়িয়ে রয়েছে স্থাপত্যের নিদর্শন। যা  কালের স্বাক্ষী ও গবেষণার বিষয়বস্তু।

বালিয়াটি জমিদার বাড়ির অদূরে ১৯২০ সালে স্থাপন করা হয়েছিল ব্রিটিশ শিক্ষা ব্যবস্থার মানদন্ডে একটি স্ট্যান্ডার্ড স্কুল। স্কুল প্রতিষ্ঠার ইতিহাসে রয়েছে এক হৃদয় বিদারক আত্মাহুতির কাহিনী। সে সময়ে এ স্কুলটিতে শুধু অভিজাত শ্রেণীর সন্তানরাই পড়াশোনা করতে পারত। বর্তমানে এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। বর্তমানে অবশ্য স্কুলটিতে বাংলা পাঠ্যসূচী অনুযায়ী শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালিত আছে। রায় বাহাদুরের আর্থিক সহযোগিতায় প্রতিষ্ঠিত এ স্কুলটির পুরোনো ভবন এবং নারিকেল সুপারী বীথী সমৃদ্ধ প্রাঙ্গন বড়ই মনোহর। সাজানো গোছানো স্কুল চত্বর আর জমিদার বাড়ির বাহিরে ছড়িয়ে থাকা বেশ কয়েকটি বিশাল দীঘি শান বাঁধানো ঘাট বিগতদিনের সমৃদ্ধির স্মৃতি বহন করে চলেছে। এসব দর্শণীয় স্থান দর্শনার্থী ও গবেষকদের গবেষণার খোরাক যোগাতে কালের স্বাক্ষী হয়ে দাড়িয়ে আছে।

 

অনুগ্রহ করে এই পোস্টটি আপনার সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করুন।

এই বিভাগের আরও খবর...
© All rights reserved © ২০২৫ বাংলা টপ নিউজ ২৪
ESAITBD Sof-Lab UAE/BD