শনিবার, ০১ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ০১:৫৯ পূর্বাহ্ন
বিজ্ঞপ্তি :
বাংলাটপনিউজ২৪.কম-এ দেশব্যাপী জেলা-উপজেলা পর্যায়ে সংবাদকর্মী নিয়োগ চলছে। সরাসরি যোগাযোগ করুন -banglatopnews24@gmail.com. মোবাইল-০১৭৪৩৯৯৮৭৪১.

একজন ছমির মোল্ল্যা !

রিপোর্টার নাম
  • আপডেটের সময়: সোমবার, ২৭ জানুয়ারি, ২০২৫
  • ৬২ সময় দেখুন

এক.
সকাল থেকেই টিনের চালে টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে। বিছানায় ‘দ’ আকারে পাতলা কাঁথা গায়ে শুয়ে আছে ছমির মোল্ল্যা। সকালের এই মিষ্টি ঘুম থেকে বৃষ্টির শব্দের কারণেই তার উঠতে ইচ্ছা করছে না। মাথার ভিতরে ঝিম ঝিম করছে ভোর রাতের স্বপ্নটা! শাপলা বিলে নৌকা থেকে সে পড়ে গেছেন, তার নৌকা ভেসে যাচ্ছে, সে জড়িয়ে যাচ্ছে জল শেওয়াতে। এতটুকুই তার মনে পড়ছে। কিন্তু শাপলার বিলে তার যাবার কথা না। সেই ছোট বেলায় শাপলার বিল ছেড়ে এই করিমগঞ্জে চলে আসা হয়েছে। এরপরে আর কখনই শাপলার বিলে যাওয়া হয়ে ওঠে নি তার। এত বছর পরে আবার শাপলার বিল স্বপ্নে দেখে তার মন ব্যকুল হয়ে উঠেছে। খোয়াব নামার বইয়ে ছমির পড়েছে ভোর বেলার স্বপ্ন নাকি সত্যি হয়।

অন্যদিন এত বেলায় পাখির ডাক শোনা যেত কিন্তু আজ বৃষ্টির কারনে পাখির ডাকও শোন যাচ্ছে না। টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ, সঙ্গে মেঘের গুড়ুম গুড়ুম শব্দে ছমির পাশ ফিরিয়ে শুলো।

আজ সোমবার। কিস্তি দেবার তারিখ। কিন্তু কিস্তির পুরো টাকা তার যোগাড় হয় নাই। কাল বেশ কিছু জায়গায় চেষ্টা চালিয়েও সে সব টাকা যোগাড় করতে পারে নাই।

খাও না খাও কিস্তি দেওয়াই লাগবে। দশ বছরের লতিফা টাইফয়েড জ্বরে পড়লে ক্ষুদ্র ব্যাংক থেকে দশ হাজার টাকা লোন নেয় ছমির মোল্লা। বর্ষার সময় জোগালের কাজ কম থাকে, তাই এই সপ্তাহের কিস্তির টাকা তার জোগাড় হয় নাই। ছমির মোল্ল্যা নাম তার। শাপলার বিলের মোল্ল্যা বংশের ছেলে সে। কারো টাকা মেরে খাওয়া কোন ইচ্ছাই তার কোন কালে ছিল না। আর বেঁচে থাকতেও সে ইচ্ছা হবে না।

সেবার কদম আলীর দোকানে তার বত্রিশ টাকা বাকি হয়েছিল। গ্রামের দোকান ছেড়ে গঞ্জে নতুন দোকান দেয় কদম আলী। দু’মাস পরে ছমির মোল্ল্যা গঞ্জে গিয়ে তার পাওনা টাকা দিয়ে আসে। কদম আলীর সেকি হাসি! হাসে আর বলে কত জনের কাছে কত টাকা পামু তা দেয় না, আর মিয়া তুমি এতদূর আইছ আমার বত্রিশ টাকা দেবার জন্য। তার সততার এমন আরো দশ-বারোটা কান্ড গায়ের লোকের জানা আছে। কিন্তু ব্যাংকের ম্যানেজারের কাছে তার এই সততার কোন দাম নাই। গ্রুপের সাবার সঙ্গে তার টাকাও দেওয়া লাগবে। ম্যানেজারে কোন ভাবেই বোঝানো যাবে না, বর্ষায় চারিদিকে পানিতে ভরে গেছে। এখন জোগালের কোন কাজ নেই।

গোয়ালের গরুর বিরতীহীন হাম্বা হাম্বা ডাকে আর শুয়ে থাকতে পারল না ছমির মোল্ল্যা। ঘুম থেকে উঠেই বৃষ্টিতে ভিজতে মন না চাইলেও কোন উপায় ছিল না। এক টুকরো উঠান পার হয়ে গোয়াল ঘরের দিকে এগিয়ে যায় সে। গরুর দিকে চাইতেই তার মন খারাপ হয়ে যায়। বর্ষার পানিতে মাঠ ঘাট ভরে যাওয়াতে অবলা গরুটা যে ঘাস খেতে পারছে না, শরিরের হাড় গুলোই সেই সাক্ষি দিচ্ছে। গোয়ালের মাঁচায় গুঁজে রাখা কাঁচিটা হাতে তুলতে যাবার আগে বেশ টাইট করে পরনের লুঙ্গিটা কাঁছা দিয়ে নিল সে। কোমরে বেধে নিল তেল চিটচিটে গামছাটা।

গায়ের গেঞ্জি খুলে গোয়ালের আড়ে গুজে রেখে টিপটিপ বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বিলের কচুরিপানা কাটাতে যাবার জন্য পা বাড়ালো সে। পিছন থেকে রাবেয়ার গলা ভেসে এলো। ভিজা কাঠে ফু দিয়ে আগুন জ্বালানো চেষ্টায় ধোঁয়ার মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে রাবেয়া। স্বামির দিকে তাকিয়ে হাত দিয়ে চোখ ঢাকার চেষ্টা করে বলে উঠল-

গায়ে সরিষার ত্যাল মাইখা তারপর পানিত নামতে যান। বর্ষার এই পানির কামড় শরিলের জন্য ভাল না। তা ছাড়া সকাল সকাল বৃষ্টিতে ভিজতাছেন। জ্বর আসলে কিন্তু কিছু করার থাকবো না।

রাবেয়ার কথার কোন উত্তর না দিয়ে সজোরে পা চালায় ছমির মোল্ল্যা। রাবেয়ার চোখের সিমানা ছাড়িয়ে সে চলে আসে বিলের পাড়ে। তার আগেও যে আরো কেউ কচুড়িপানা কেটে গেছে তা দেখে মাথাটা একটু গরম হয়ে গেল তার। পাড়ের কাছে আর কোন কুচরি অবশিষ্ট নেই। তার জন্য যা আছে তা কাটতে কম করে বুক পানিতে নামতে হবে। এই কাজে দেরি করলে নৌকা নিয়ে আসা বদরের ছোট ছেলে বাকি কচুরিও কেটে ফেলতে পারে।

তাই সে আর দেরি না করে কাঁচি হাতে বিলের পানিতে নেমে পড়ল। মুঠি মুঠি কচুরির পানা কাটতে কাটতে নিজের মনেই সে আওড়ে যাচ্ছে, জমিদারের ব্যেটি কয় কি জ্বর আসলে কিছু করার থাকবে না। ব্যেটি কি ডাক্তার নাকি যে কিছু করবি। আমারে নিয়ে তার চিন্তার শেষ নাই! আজ যে সোমবার, ব্যাংকের কিস্তি দিতি হবি সেই চিন্তা কি তার আছে? কত করে কলেম এসব কিস্তি উঠানোর দরকার নেই, সামান্য জ্বর হয়ছে মাইয়ের, ভুপেন ডাক্তারের ঔষুধ খাইলেই ভাল হয়ে যাবে। কে শোন কার কথা। তিন দিনির জ্বর যখন সাত দিনিও যায় না তখন সে পাগল হয়ে গেল। শহরে নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করে তবেই জমিদারের ব্যাটি ভাত মুখে দিল।

বৃষ্টি তেজ কয়েক গুন বেড়েছে। বর্ষার পানি ভেদ করে বিলের ওপাড়ের মতলব মুন্সীর ঘরটিও ছমির দেখতে পাচ্ছে না। মাথার উপরে ধোঁয়ার রং এর মেঘ আর চারপাশে সাদা বৃষ্টি। পানির উপর পানি পড়ার শব্দের তালে তালে ছমির মোল্ল্যা কচুরি কেটে যাচ্ছে। বদরের ছোট ছেলে আলালের ডাকে তার নুয়ে থাকা মাথাটা উপরে উঠল। কচুর বড় একটা পাতা মাথায় দিয়ে বৃষ্টি থেকে নিজেকে রক্ষা করে নৌকা বাইছে আলাল। বদর তার চাচাতো ভাই। তার দুই ঘর উত্তরে বদরের ঘর।

ছমির মোল্ল্যার মাথা আজ গরম তার উপর এই ছেলের কথা শুনে তার মাথা আরো গরম হয়ে উঠল। কচুরিপানা কাটছে দেখেও সে জিজ্ঞাসা করল কি কর কাকা? দাঁত খেচি দিয়ে সে উত্তর দিলো, চোহে কি ছানি পড়ছে? দেহ না কি করি। আলাল নিজেকে সামলে নিয়ে প্রতিউত্তর দেয়, এই গুলা কি গরুর জন্য কাটো কাকা? ছমির পান খাওয়া লালছে দাঁত গুলো বের করে, উত্তর দেয়, নিজে খাওয়ার জন্য কাটতাছি। বদের হাড্ডি কুনহানকার।

মাথার কচুপাতা আরো ভাল করে দিয়ে আলাল বলল, কাকা রাগ কইর না, কাইল বিকালে ত্রিশটা শোলায় বর্শি গাইথা পানিতে ফেইলা গিছিলাম। সকালে আইসে দেহি ছয়ডাতে শইল-টাকি বাঁধে আছে। চারডা বর্শি পাই নাই। তোমার কচুড়িপানার আশে পাশে আছে কিনা তাই খুঁজতি আসলাম।

আর একটু পরেই ছমিরের কিস্তি, ছেলেমানুষি কার্মকান্ডে তার এতটুকু আগ্রহ নেই। বর্শি খোঁজার ব্যাপারে কোন দৃষ্টিপাত না করে নিজের কাজে মন দিল সে। আলাল এদিক ওদিক খুঁজার চেষ্টা করে নৌকা বেয়ে সামনের দিকে চলে গেল।

বিকাল পর্যন্ত গরুর জন্য যতেষ্ট খাবার যোগাড় হয়েছে, যদি লাগে বিকালে আরাক দফা কাটা যাবে এই ভেবে পানি থেকে উঠে পড়ল ছমির। পাড়ে বর্ষার নতুন পানিতে সদ্য গজিয়ে ওঠা কমলি শাক নজরে পড়ল ছমিরের। কমলির ঝোলের সঙ্গে ছোট মাছ! ভাবতেই তার জিভে পানি চলে এলো।

কোমর থেকে গামছা খুলে কচুরি আঁটি বেধে বিলের পাড়ে রেখে কমলি তোলায় মন দিল সে। খানিকবাদে বৃষ্টিতে মাথায় কচুরির আটি ও হাতে কলমিলতা নিয়ে বাড়ির পথ ধরল। পায়ের নিচে নরম কাঁদা প্যাঁক প্যাঁক শব্দে সরতেই মনে মনে ছমির ভাবল, বৃষ্টির মধ্যে নিশ্চই আজ ব্যাংকের স্যার কিস্তি নিতে আসবে না। পরের সপ্তা আসলে আর কিস্তি দিতে কোন অসুবিধাই হবে না। বুধ, বৃহস্পতি, শুক্র এই তিনদিন তার টানা কাজ আছে। পাশের গ্রামের আদর আলীর বাড়িতে তার জোগালের কাজ করার কথা। একটা ডোরা সাপ দ্রুত বেগে ছমিরের পাশ দিয়ে পাশেই ঝোঁপের মধ্যে মুহুর্তে মিলিয়ে গেলো। ছমির একবার সেদিকে তাকিয়ে মুখ দিয়ে হিস হিস শব্দ করে সামনে এগিয়ে গেলো।

রাবেয়া তখনও চুলার পাশে বসে আছে। ভাত যখন উথলে গেছে তখন তার ভিতরে আলু আর ঢ্যারশ ছাড়ছে। বৃষ্টির কারণে লতিফা আজ স্কুলে যায়নি। ঘরের বারান্দায় পাটি পেতে সে পাশের বাড়ির আঞ্জুর সঙ্গে লুডু খেলছে। লতিফার চার উঠলেই তার গুটি ঘরে চলে যাবে। আর আঞ্জুর পাঁচ উঠলেই তার পাঁকা গুটি কাঁটতে পারবে। খেলার এই টানটান মুহুর্তে ছমির মোল্ল্যা মাথায় আটি নিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করতেই গরুটা আবার ডাকা শুরু করল। কমলি শাকগুলো রান্না ঘরের বারান্দায় ছুঁড়ে দিয়ে ছুটল গোয়াল ঘরের দিকে। চাঁড়ে কচুড়িপানা দিয়ে গরুটার সারা শরিরে হাত বুলিয়ে দিতে থাকে সে। লেজ নেড়ে নেড়ে বিরামহীনভাবে সদ্য তুলে আনা কঁচুরি চিবোতে লাগল লাল রংএর দেশি গরুটা। লতিফা এই গরুটার নাম দিয়েছে লালি।

বৃষ্টি শেষ না হলেও পাতলা হয়ে গেছে। কলপাড়ে গিয়ে নিজে ভাল করে শরির ঘেষে গোসল শেষ করতেই রাবেয়া বলে উঠল, কিস্তির টাকা কি যোগাড় হইছে? ছমির কোন কথার উত্তর দেয় না। পরনের লুঙ্গিটা বালাতির মধ্যে ধুয়ে, হাতে নিয়ে চিপড়ে লতিফার দিকে তাকিয়ে গর্জণ করে খেঁকিয়ে উঠল ছমির, ‘সকাল বেলা স্কুলের নাম নাই। লুডু নিয়া বাইছস কেন?’ আঞ্জু এইমাত্র তার পাকা গুটি কেটেছে। সেই শোকে তার মন ছিল খারাপ তার উপর বাবার এই ধমকের জন্য ছোট মেয়েটা মোটেই প্রস্তুত ছিল না। অপলক চোখে মা’র দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি বিনিময়ে বাবার নামে বিচার দেবার চেষ্টা করলো।

রাবেয়া প্রতিবাদ করে মেয়ের পক্ষ নিয়ে বলল, ‘ও স্কুলে যাইব কেমনে? হোসেন পাড়ার বাঁশের পুল ভাইঙ্গা গেছে। সেই সঙ্গে খালের পানিতে স্রোত বাড়ছে। ও ছোট মানুষ একা স্রোত পার হইবো কেমনে? ছমিরের কটাক্ষ গলা। একা যাইবো কেমনে? আরে আমি ছোট বেলায় একা বিল পার হইয়া মক্তবে যাইতাম। খালে স্রোত বাড়ছে বইলা দুনিয়ার মানুষ ঘরে বইসা থাকবো তাই না? যদি সত্যি ঘরে বইসা থাকতো তাইলে তো ভালাই হইত, আজকা আমার আর কিস্তি দিতে হইতো না। ঝড়, বৃষ্টি তুফান কোনো কিছুতেই তো কিস্তি বাদ যায় না। ভাত-তরকারি কি কিছু হইছে? নাকি সারাদিন হুদাই চুলার পাড়ে বইসা আছো।

রাবেয়া বুঝতে পেরেছে, আজ তার খসমের ম্যাজাজ ঠিক নাই। কিস্তির টাকা জোগাড় হয় নাই। কাল রাতে যখন ছমির কোন কিছু না খেয়েই শুয়ে পড়ে তখনই রাবেয়া বুঝা উচিত ছিল। নিজের এই বোকামির জন্য বেশ খারাপ লাগছে তার। গলার স্বর নিচু করে বলল, ভাত, ডাল আর ভর্তা হইছে। ঘরের ভিতর থেকে নিজের যুব্বা পরে কালো রং এর ছাতাটা নিয়ে বের হতে হতে ছমির বলল, বেশি গরম ভাত খাওয়া ভাল না। আমি আসতাছি। রাবেয়া জানে এখন আপত্তি বা অভিযোগ কোন কিছুই কাজে আসবে না। তিনি যে এখন কিস্তির টাকা জোগাড়ের শেষ চেষ্টায় বের হচ্ছে সেটা রাবেয়া বুঝতে পারল। বারান্দার এক কোনে পড়ে থাকা কমলি শাকগুলো তুলে পাতা বাছতে শুরু করল রাবেয়া।

দুই.
আজগর মুদি দোকানদার হলেও তার টানাটানির সংসার। নিজের হাতে টাকা নেই, দোকানের প্রায় ফাঁকা মাচাগুলোও সে মাল দিয়ে ভরতে পারছে না। গ্রামের যারা তার কাছ থেকে বাকি খায় তারা কেউ বকেয়া শোধ করতে পারছে না। লাল রং এর হিসাবের খাতাটা পাওনাদারের নাম ও পাওনার হিসাবে ভর্তি হয়ে গেছে। আজগর তারপরেও ছমির মোল্ল্যাকে সান্তনা দেয়, দু’দিন পরে তার কিছু টাকা আসার কথা। তখন সে তাকে ধার দিতে পারবে। কিন্তু ব্যাংকের স্যার যে তাকে দু’দিনের সময় দেবে না সেটা সে আজগরকে বোঝাতে পারল না। একে একে রতন, আমজাদ ও সাদেক মাস্টারের কাছ থেকে হতাশ হয়ে ফিরে দশটা নাগাদ বাড়ি আসতেই লতিফা বলল, বাবা, ব্যাংকের স্যার আঞ্জুদের বাড়িতে কিস্তির টাকা নিতাছে। আপনারে যাইতে কইছে।

ছমির মোল্ল্যার তখন পেটে ভিষন ক্ষিদে। মনটা বউএর হাতের ডাল, ভর্তা আর ভাত খাবার জন্য ছটফট করছে। পায়ে কাঁদা নিয়েই মন মরা হয়ে বারান্দায় বসে পড়ল সে। ছমিরের চোখ পড়ল নিজের ডান হাঁটুর একটু উপরে। জায়গাটা এখনো কালচে হয়ে আছে। পরশু কচুড়ি কাটতে বিলের পানিতে নামলে একটা মইষা জোঁক তার হাঁটুর উপরের এই স্থানে রক্ত পান করে, রুটি বেলা ব্যালনের মত হয়ে গিয়েছিল। শেষে জোঁকের মুখে লবণ দিলে তার মুক্তি মেলে। আজ ব্যাংকের স্যারকে ছমিরের সেই জোঁক বলে মনে হচ্ছে। আর লবণকে মনে হচ্ছে টাকা। লতিফা আবার এসে বলে, বাবা তোমাকে ডাকছে, ব্যাংকের স্যারের নাকি সময় নাই।

ছমির মোল্লা আর কোন কথা না বলে উঠে পড়ল। মনে মনে স্যারকে কি বলবে আওড়ে নিয়ে তার সামনে হাজির হলো।

‘ছমির টাকা কই?’

স্যার পুরাডা জোগাড় হয় না। সামনের সপ্তাহে দিয়া দেবো। বর্ষার কোন কাম-কাজ নাই। কাইল থাইকা কয়েক জনের কাছে টাকা ধার চাইছি কেউ দিতে পারে নাই।

এইগুলা কইলেতো চলব না। টাকা নেবার সময়তো এই কথা ছিল না। তোমার একার টাকার জন্য পুরা গ্রুপের টাকা মিলব না। যেমনে পারো পুরা টাকাই তোমার দেওয়া লাগবো।

ছমিরের প্রতিবাদ ভরা কণ্ঠ, কইলামতো আগামী সপ্তাহে আমি সব দিয়া দিতে পারবো। ছমির মোল্ল্যার কারো টাকা মারার ইচ্ছা নাই। খোঁজ নিয়া দেহেন আমার কাছে কেউ কোন টাকা পাইবো কিনা।

আরে মিয়া, আমার কাজতো তোমার খোঁজ নেওয়া না। আমার কাজ পাওনা টাকা তোলা। অত কথা না বইলা জলদি টাকার ব্যবস্থা কর। আমি উত্তর পাড়া ঘুইরা আসতাছি, এর মধ্যেই পুরা টাকা জোগাড় কইরা রাখবা। ছমিরের দৃঢ় প্রতিবাদ, উত্তরপাড়া থাইকা ঘুইরা আসলেও আমি আইজ টাকা দিতে পারমু না। আমার টাকা যোগাড়ের কোন পথ নাই। ব্যাংকের স্যার কোন কথা না বলে সাইকেলে ওঠে উত্তর পাড়ায় চলে গেল।

আঞ্জুর মা বলে উঠল, পুল ভাঙ্গছে তাও নৌকায় কইরা ঠিক সময় টাকা তুলতে চইলা আসছে। মানুষের সময় অসময় কোন কিছুই তারা বোঝে না আর বুঝতে চায়ও না। ছমির আর কোন কথা না বলে নি:শ্বব্দে বাড়ির দিকে পা বাড়াল।

রাবেয়া থালায় ভাত বেড়েছে অনেকক্ষণ, দু’তিনটা মাছি তার উপর একমনে লাফাচ্ছে। সেদিকে লক্ষ্য নেই ছমির মোল্ল্যার। ভোর রাতের স্বপ্নটা তার আবার মনে পড়ল। শাপলার বিলে নৌকা থেকে সে পড়ে গেছে। তার নৌকা দূরে ভেসে যাচ্ছে। শাপলার বিলের গোলাপী শাপলার লতায় তার শরির পেঁচিয়ে যাচ্ছে। সে কিছুতেই তার নৌকা ধরতে পারছে না।

কলপাড় থেকে গোসল সেরে এসেও যখন রাবেয়া দেখল ভাত তেমনই আছে। তখন আর সে কোন কথা না বলে ভাতের থালায় ঢাকনা দিল। ছমির একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে বারান্দার খুঁটি বেয়ে পিঁপড়ার দলের ওঠা নামার দিকে।

তিন.
ব্যাংকের স্যার ছমিরের বাড়ির উঠানে। টাকা যোগাড় হয়নি এটা সে কিছুতেই শুনতে চায় না। ছমির কোনভাবেই যখন স্যারের কাছ থেকে সময় পেল না তখন সে রাগের মাথায় জানতে চাইল এখন তার করনীয় কি? ব্যাংকের স্যার ভারি গলায় উত্তর দিল, ব্যাংকের নিয়ম হলো, হয় টাকা না হয় অন্য কিছু। তোমার ঘর থেকে অন্য কিছু নিয়ে যেতে হবে। তুমি টাকা দিলেই তোমার জিনিষ তোমার হয়ে যাবে। ছমিরের ব্যাকুল কণ্ঠে ভেসে আসে, আমার ঘরে কি আছে যে, সেটা আমি দেব।
ব্যাংকের স্যার এদিক ওদিক দেখে বলে, গোয়ালের গরুটা ব্যাংকে জমা রাখতে পারো।

ছমির হাউমাউ করে উঠল। গরু! গরু নেবেন ক্যান?

ব্যাংকের স্যারের জবাব, এখন তো তুমি টাকা দিতে পারছ না। তাই এই ব্যবস্থা। আমার কিছুই করার নেই, আমি ব্যাংকের নিয়মের কাছে বাঁধা। তুমি চিন্তা করো না। টাকা ফেরত দিলেই তোমার গরু তোমার হয়ে যাবে। আমার সঙ্গে নৌকা আছে। গরু নিয়ে যেতে আমার কোন অসুবিধা হবে না।

এই কথাগুলো ছমিরের মস্তিকের ভিতর যেতেই তার মাথা গরম হয়ে উঠল। ক্ষ্যাপা বাঘের মত ঝঁপিয়ে পড়ল ব্যাংকের স্যারের উপর। সর্বশক্তি দিয়ে স্যারকে ধাক্কা দিয়ে দূরে ঢেলে দিল সে। হাতের কাছে পড়ে থাকা কোঁদালের আছাড়ি তুলে নিল হাতে। বলে উঠল নিকুচি করি আপনার ব্যাংকের নিয়ম। সাহস থাকলে আমার গরুর গায়ে হাত দেনতো দেহি, বুকের মধ্যে কলিজাটা কত বড় হইছে।

স্যারের তীব্র প্রতিবাদ। ‘কাজটা কিন্তু তুমি মোটেও ঠিক করতাছ না ছমির।’ স্যারের সাইকেল লাথি মেরে ফেলে দিয়ে ছমির বলে উঠল, ‘কাজের এখনো দেখছেন কি? এখনই আমার বাড়ির থাইকা বাহির না হইলে এই আছাড়ি দিয়া আপনার মাথা আমি দুই ভাগ কইরা দেব।’

বিয়ের বয়সে স্বামির এত রাগ কখনো রাবেয়া দেখে নাই। বারান্দার খুঁটি ধরে সে মেয়েকে নিয়ে অবাক চোখে দাঁড়িয়ে আছে। মাটিতে পড়ে থাকা সাইকেল তুলতে তুলতে স্যার বলল, কাজটা তোমার মোটেও ভাল হল না ছমির। এর ফল তোমার ভোগ করতেই হইবো। ছমিরের দিকে অগ্নিদৃষ্টি দিয়ে একবার দেখে নিয়ে সাইকেল হাতে ঠেলে দ্রুত সে বের হয়ে গেল।

ব্যাংকের স্যার ছমিরের বাড়ি ছেড়েছে দু’ঘণ্টা হবে। ঠান্ডা ভাতের সঙ্গে কলমি শাক দিয়ে অর্ধেক ভাত শেষ করতেই, আলাল দৌড়ে উঠানে প্রবেশ করল। ভীত কণ্ঠে চিৎকার দিয়ে সে বলল, কাকা তোমারে ধরতে পুলিশ আইতাছে। তুমি পালাও। ছমির সে কথায় কান না দিয়ে বউ এর দিকে ফিরে বলল, আর একটু মাছের তরকারি দাও। পরিস্থিতির ভয়াবহতা বুঝতে পেরে রাবেয়া আঁচল মুখে গুজে ডুকরে কেঁদে উঠল।
লেখক- রাহুল রাজ।

অনুগ্রহ করে এই পোস্টটি আপনার সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করুন।

এই বিভাগের আরও খবর...
© All rights reserved © ২০২৫ বাংলা টপ নিউজ ২৪
ESAITBD Sof-Lab UAE/BD